Wednesday, March 2, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৮ (আল হাবালা- The Hanging Village)


মনির ২ মাস আগে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে। কিন্তু তার পোস্টিং আভা’তে হয়নি, হয়েছে মাহাইল (Mahail) ক্যাম্পাসে । মাহাইল আভা’র মতো ঠান্ডা জায়গা নয়, বেশ গরম- ৩০ ডিগ্রির উপরে। সেখানে ৩/৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষক আছেন, কিন্তু তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। মনির নিঃসঙ্গ হয়ে গেল, ক্যাম্পাস, বাসা, টুকিটাকি বাজার- এই করেতো সময় কাটেনা। সে আমাদের মিস করতে থাকলো ... আমাদের বন্ধুদের আড্ডা বলে কথা!

তবে এরই মাঝে একটা সুযোগ হল ... সৌদি বাদশাহ স্বাস্থ্য উদ্ধার করে দেশে ফিরছেন, সারাদেশে আনন্দ। সেই আনন্দে শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি)ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে শোনা যায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে গণআন্দোলন দেখে, উনি অবকাশ যাপন কেন্দ্র থেকে কিছুটা তড়িঘড়ি করেই দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই সবাইকে খুশি করতে ৩৬০০ কোটি ডলারের সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেন।


আমাদের বৃহঃপতি ও শুক্রবার ছুটি, শনিবার মিলিয়ে টানা ৩ দিনের ছুটি হয়ে গেল। মনিরও বেশী দেরী করা সমিচীন মনে করেনি। বুধবার বিকেলেই জুঁই’কে (ওয়াইফ) নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির। আমরাও খুশীতে আটখানা, ও থাকলে আড্ডাটা বেশ জমে উঠে। সে রাতে ৩টা পর্যন্ত আড্ডা হলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম “আল হাবালা” ঘুরতে যাব।


হাবালা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। আভা হতে ৪০ মাইল দূরে চমৎকার একটি টুরিস্ট স্পট। হাবালাকে বলা হয় ঝুলন্ত গ্রাম/দড়ি’র গ্রাম (Hanging Village/Village of Rope)। ১৯৭০ সালে মাইনিং রিসার্চ সেন্টারের একটি দল হেলিকপ্টারে অনুসন্ধানের সময় অদ্ভুত এই গ্রামটি দেখতে পায়। পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত একটি গ্রাম। পাহাড়ের মাথা হতে ৪০০ মিটার নীচে পাহাড়ের ফাঁটলে গ্রামটি গড়ে উঠেছিল। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে চলাচল বা বের হবার কোন উপায় ছিলনা, চারদিকই ছিল পাহাড় বেস্টিত। যোগাযোগে একমাত্র উপায় ছিল দড়ি বেয়ে পাহাড়ের মাথার দিকে উঠা। প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দড়ি’র মাধ্যমে নামানো হতো। খুঁজে পাবার পরে গ্রামবাসীদেরকে কিং ফয়সাল ভিলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। কেন তারা ওখানে ছিল? আগেই বলেছি, এ অঞ্চল একসময় তুর্কিরা শাসন করতো। আসির প্রদেশে (আভা হলো আসির প্রদেশের রাজধানী)কাহতানিরা (Qahtan Tribe) সবসময় প্রভাবশালী। সময়ক্রমে কাহতানিরা তুর্কিদের এ অঞ্চল হতে তাড়িয়ে দেয়। তুর্কিদের শাসনামলে নিরাপদে থাকার জন্যেই কাহতানিদের একটি গ্রুপ এখানে আবাস গড়ে।

পরবর্তীতে একে টুরিস্ট স্পটে পরিণত করা হয়। এখানেই আছে সৌদি আরবের ১ম কেবল কার। ৬০০ মিটার দীর্ঘ কেবল কারে করেই নীচের গ্রামটিতে নামতে হয়।


আল হাবালা- The Hanging Village

... তো বৃহঃপতিবার বিকেল ৩ টায় আমি ও শাকিলা, মনির ও জুঁই, মিলন ও লিজা, দিবা ও তার আব্বা এবং ইশরাত, ৯ জন রওনা দিলাম হাবালার উদ্দ্যেশে।




এখন এটি টুরিস্ট স্পট


৩০ মিনিটেই পৌছে গেলাম। পাহাড়ের একটি অংশকে দেখে আমার ওয়েস্টার্ন মুভি’র কিছু দৃশ্য মনে পড়ে গেল। পাহাড়ের প্রান্তে তারের বেড়া দেয়া, নীচের দিকে তাকাতেই ঝুলন্ত গ্রামটি দেখতে পেলাম।একটা জিনিষ গুলিয়ে ফেললে চলবেনা। আভা- পাহাড়ের উপরে তৈরি একটা শহর। শুরু হলো আমাদের ছবি তোলা। মনির একজন স্বাস্থ্যবান ছেলে, যে কোন ছবি তুললেই তার ৯০% জায়গা জুড়ে সে থাকে। মিলন ও লিজা কিছু রোমান্টিক ছবি তুলল। আমরা দু’জনও বেশ কিছু ছবি তুললাম-ভদ্র ছবি। ইশরাত একা ছিল, ছবি তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহও ছিল বেশ। কি আর করা ! আমি অনেকগুলো ছবি তুলে দিলাম।তবে আমার আগ্রহ ছিল প্রকৃতির দিকে। মরুর বুকে এতো চমৎকার কিছু ফুল ফুটে ছিল যে বার বার অবাক হচ্ছিলাম কিভাবে এগুলো বেঁচে আছে। এতো সতেজ আর মোহময়ী।



অনাদরে বেড়ে উঠা ...

সামনেই কেবল কার স্টেশন, ভেতরে ঢুকতেই কৃত্রিমভাবে লাগানো ফুল চোখে পড়ল। একটা জবা গাছও দেখলাম।




বাগানে লাগানো ...

টিকেট কাটতে গিয়ে দেখলাম দু’জন বাংলাদেশি ভাই টিকেট বিক্রি করছে। টিকেটের দাম জনপ্রতি ৪০ রিয়াল। উনারা আমদের ডিসকাউন্ট দিলেন, ৩০ রিয়াল করে রাখলেন। এই প্রথম কেবল কারে চড়ছি, আমার ধারনা ছিল কেবল কার হরিজন্টাল পথে চলে। কিন্তু এটা পাহাড়ের উপর হতে নীচে নামছে, ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে। জুঁইতো ভয়ে চোখ বন্ধ করলো আর মনিরকে খাঁমচে ধরলো। নীচে সবকিছু সাজানো গোছানো, ভালো লাগলো। মনেই হয়নি মরুভূমিতে আছি ... চারিদিকে গাছের জঙ্গল- বাংলাদেশের মতো সবুজ। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, দৌড়ে বেড়ালাম।


কেবল কার, নীচে নামছে

কেবল কার লাইন

উপর হতে দেখা ...

অনেক সাজানো গোছানো

ফণীমনসার ঝোপ

মেয়েরা আবিষ্কার করলো এখানে কিছু ‘জিরা গাছ’ জন্মেছে, আমরা ঘ্রাণ নিলাম। এখানে সেখানে কিছু ভাঙ্গা ঘর/বাড়ি ছিল, আগের দিনের বসতি। বেশ কিছু সৌদি ফ্যামিলিও ঘুরতে এসেছিল, তারা অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। ওখানে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানেও এক বাংলাদেশি। ড্রিঙ্কস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে বাসার পথে...


খাবারের জন্য অপেক্ষা ...

ড্রিঙ্কস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই

বাসার পথে...
বাসায় আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। রাতে আমাদের বাসায় মনির আর মিলনদের খাবার দাওয়াত ছিল। কিছুই করা হয়নি। বাজার করে রান্না শেষ হতে হতে রাত ১১ টা। খিচুরি, মুরগির মাংস, সর পুটি আর হামুর মাছ (সী ফিশ) খেলাম তৃপ্তিভরে। তারপর ম্যারাথন আড্ডা, মনির আসর জমিয়ে রাখলো তার মতো করেই। রাত ৩ টা বেজে গেলেও কেউই তো উঠতে চায়না, শেষ পর্যন্ত জোর করে তাদের বের করতে হলো।


দি এ টিম ...

No comments:

Post a Comment