Wednesday, January 26, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৬ ( ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ও অন্যান্য )

১৮ সেপ্ট. জয়েন করলাম। ক্যাম্পাস দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আগে সৌদিরা লেখাপড়া বিমুখ থাকলেও এখন তারা বুঝতে পেরেছে এটা ছাড়া তাদের গতি হবে না। তারা এখন মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে। কিছুদিন আগেই ড. ইউনুস কিং আব্দুল্লাহ ইউনিভার্সিটি উদ্ভোধন করে গেলেন। শিক্ষায় খরচ করতে এদের কার্পণ্য দেখিনি। ১৯৯৮ সালে কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি ও ইমাম মোহাম্মদ ইবনে সৌদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি একত্রিত হয়ে কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্র/ছাত্রী প্রতিমাসে ১০০০ রিয়াল (১৮৫০০ টাকা) করে ভাতা পায়। ভালো ছাত্র/ছাত্রীরা মাস্টার্স ও পিএইচডি’র জন্য USA/Canada তে ফুল স্কলারশিপ পাচ্ছে।


কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস

... এখানে এসেই পড়লাম সমস্যায়। ইউনিভার্সিটি অথবা মার্কেটে যাব কিন্তু কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। ট্যাক্সি নিতে হয়। এখানে সবারই প্রাইভেট কার আছে। এবং প্রত্যেক ফ্যামিলি মেম্বারের জন্য ১টি করে প্রাইভেট কার। আমি আজও কোন সৌদিকে রাস্তায় হাটতে দেখিনি। ফলে যেখানে তাকাই শুধু গাড়ী আর গাড়ী। আর মজার ব্যপার হলো এদের বাড়িতে গ্যারেজ নেই, এরা গাড়ী রাখে রাস্তায়। চুরি হয়না বলেই হয়তো গ্যারেজ করার কথা ভাবে না। প্রথম যেদিন ক্যাম্পাস গেলাম, অবাক হতে হলো- ক্যাম্পাসের চারপাশ জুড়ে গাড়ী পার্কিং ব্যবস্থা এবং যা ক্যাম্পাসের আয়তনের চেয়েও বড়।



গাড়ী পার্কিংয়ের একাংশ

এডমিন অফিসে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট করলাম। সবাইকে আন্তরিক মনে হলো। ২ দিনের মধ্যেই চমৎকার অফিস রুম পেয়ে যাই – যা এককথায় লোভনীয়।



অফিস রুম


অফিস রুম- আরেকটি ভিউ


(চলবে)

Sunday, January 16, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৫

ভাবতেও পারিনি আমার ভিসা রিজেক্টেড হতে পারে। কন্সুলার সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইলাম। উনি ছিলেননা বলে দেখা হলোনা। আরো দু’জন শিক্ষককে পেলাম, তাদেরকেও ভিসা দেয়া হয়নি। একজন ছিলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। উনি বাকহারা ও নিজেকে অপমানিত মনে করছিলেন। উনি কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার & এনার্জি ডিপার্টমেন্টে হেড হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগেও উনি একই ডিপার্টমেন্টে হেড হিসাবে কাজ করেছেন। আবার উনাকে বিশেষ রিকোয়েস্ট করে ডিপার্টমেন্টে যোগ দেবার জন্য রাজী করা হয়েছিল। উনি আক্ষেপের সাথে বললেন, আগেরবার উনাকে এম্বাসেডর ডেকে এনে ভিসা দিয়েছিলো ...




বাংলাদেশ হতে আমরা এবার ৯ জন কিং খালিদ ইনিভার্সিটিতে নিয়োগ পেয়েছিলাম। ৮ জনই ছিল ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের, আমিই একমাত্র বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ব্যাকগ্রাউন্ড। তাই কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ ছিল না। প্রসঙ্গত বলতে হয়, শাকিলা ছুটিতে দেশে চলে এসেছিল। সে সবার সাথে যোগাযোগ করল। ৯ জনের মাঝে আমি, ইশরাত আর সুরাইয়া এ্যাম্বাসিতে এপ্লাই করে ছিলাম, বাকী ৬ জন নাকে তেল দিয়ে আরাম করছিল।


এর মাঝে শাহরিয়ার নামে একজনে সাথে পরিচয় হলো, খুলনা ইউনিভার্সিটির। মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন দিত, কি কি করতে হবে তা জানতে। যখন শুনলো আমরা কেউই ভিসা পাইনি, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না – যাবে কি, যাবে না। আমি তাকে ফোনে সাহস যোগাতাম- চলেন চেষ্টা করি, না হলে একটা সুযোগ হারাব। এক সপ্তাহ লাগলো তার সিদ্ধান্ত নিতে। একদিন সে আমার অফিসে এসে ঘুরেও গেল ... আমি কাগজপত্র ঠিক করে দিলাম।


ইশরাতের হয়েছিল আরেক সমস্যা। এ্যাম্বাসি তার কাগজপত্রই হারিয়ে ফেলেছিল ...


... পরেরদিন সকালে আমি আর শাকিলা আবার এ্যাম্বাসি গেলাম কন্সুলার সাহেবের সাথে দেখা করতে। অনেক রিকোয়েস্টের পর দেখা মিলল। আমার সাথে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানও ছিলেন। কন্সুলার সাহেব নতুন জয়েন করেছেন, যা বললেন তা হলো- উনার কিছু করার নাই, নতুন ম্যানেজমেন্ট, নতুন রুলস, নতুন পলিসি। একেবারে স্ট্রেইট কথা, আমি দমে গেলাম।


এবার আমার ওয়াইফ তার কিং খালিদ ইনিভার্সিটির অফিসিয়াল কার্ড দেখিয়ে কথা বললো। কন্সুলার সাহেব একটু নরম হলেন, বললেন- ওকে, ইনিভার্সিটি থেকে অফিসিয়াল কাউকে আমার সাথে কথা বলতে বলো।


এ্যাম্বাসি হতে বের হয়েই ইনিভার্সিটির রেজিস্টার সাহেবকে ফোন দিলাম। রমজান মাস... ইনিভার্সিটি ছুটি ছিল। তবে আশা ছিল এডমিনিস্ট্রেসন অফিস খোলা থাকতে পারে ... রেজিস্টার সাহেবকে গর গর করে সব বললাম, কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম উনি ইংলিশ বলতে পারেননা, বুঝেনওনা। উনি “খালাস, খালাস” বলে ফোন রেখে দিল। এখন সৌদি এসে বুঝেছি- “খালাস” শব্দটা ওদের কাছে কতটা প্রিয়। কাজ হোক বা নাহোক, “খালাস” করে দিতে পারলেই তারা বাঁচে।


উপায় না দেখে আমার ডীনের সাথে কথা বললাম, SMS দিলাম, বিভিন্ন ই-মেইলে মেইল করলাম। যত প্রচেষ্টা দরকার, করলাম। মেইলে কাজ হলো, একদিন একটা রিপ্লাই পেলাম- তারা আমার ব্যাপারটা দেখবে। এভাবে কেটে গেল যন্ত্রণাময় আরো ১০টি দিন। অফিস করতাম যন্ত্রের মতো, সবাই জিঙ্গাসা করতো- কবে যাচ্ছি? হেসে হেসে বলতাম, এইতো ১৮ সেপ্ট. জয়নিং।


১০ দিন পর মেইল পেলাম, তারা এ্যাম্বাসিতে কথা বলেছে, আমাকে এ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করতে বলল। পরেরদিন সকালেই এ্যাম্বাসি গেলাম। ভাগ্যক্রমে কন্সুলার সাহেবকে পেয়ে যাই। উনি নিজে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই আমার পাসপোর্ট রেখে পরেরদিন বিকেলে আসতে বললেন...


পরেরদিন বিকেলে অফিস হতে এ্যাম্বাসি যাই... ভিসা সহ পাসপোর্টটি হাতে পেলে বুঝতে পারি সত্যিই আমি ১৮ সেপ্ট. জয়েন করতে পারবো।


মূলত আমার যোগাযোগের কারণে বাকী সবার সমস্যাও দূর হয়ে যায়। কিন্তু আমি, ইশরাত ও শাহরিয়ার ছাড়া আর কেউ আসেনি। বাকী সবাই হবে কি, হবেনা এই চক্রে আর এপ্লাই করেনি। মূলতঃ আমাদের দেশের দূর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারনে আমরা অনেক সুযোগ হারাচ্ছি। ... এ্যাম্বাসি কেন আমাদের সাথে এমন ঝামেলা করলো, তা পরে জানতে পেরেছিলাম। এখানে আর তা শেয়ার করতে চাই না, সৌদি প্রবাসি সবাই বোধয় ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন, কিন্তু সেভাবে কি আমরা কাজ করছি? ... আমাদের ভাবমূর্তি কি আমরা ধরে রাখতে পারছি?




... অবশেষে ১৮ সেপ্ট. জয়েন করলাম ... সে আরেক গল্প ... (চলবে)

Saturday, January 8, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৪


ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করলাম। তারা জানাল আমার পেপার এ্যম্বাসিতে পাঠানো হয়েছে। আবার এ্যম্বাসিতে গেলাম, তারা আমার পেপার খুঁজেও পেলনা। অসহায় আমি ...  অবশেষে শেষ চেষ্টা হিসাবে শাকিলা ও মিলনের মাধ্যমে ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ হলো। আমার পেপার এ্যম্বাসিতে আবারও ফ্যাক্স করা হলো। ... এবার এ্যম্বাসি আমার পেপার পাবার কথা স্বীকার করল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তখনও বুঝিনি কি দূর্ভোগ সামনে রয়েছে ...

একে একে অনেকগুলো কাজ করতে হলো। প্রথমেই আমার অফিসে জানালাম। সবাই অভিনন্দন জানাল, তবে মন খারাপও করল। সাঈদ ভাই সিনিয়র হলেও আমার সাথে বেশ বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল, উনি বারবার আমার চলে যাওয়া নিয়ে আফসোস করতে থাকলেন। অফিসকে ৩ মাস আগেই নোটিশ দিলাম। সাথে সাথেই তানভীর ও সামসুল নামের নতুন দু’জনকে রিক্রুট করা হলো।

দুটি ইউনিভার্সিটি থেকে আমার সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশন করলাম, পুলিশ ভেরিফিকেশন হলো, মেডিকেল করলাম, এডুকেশন মিনিস্ট্রি, ফরেন মিনিস্ট্রি শেষ করে এ্যাম্বাসিতে দাঁড়ালাম।

রমজান মাস ছিলো, আমার পাসপোর্ট জমা নিয়ে পরের দিন বিকেলে কালেক্ট করতে বললো।

পরেরদিন ... নিশ্চিত ছিলাম ভিসা পাচ্ছি, ইউনিভার্সিটি বলে কথা। টোকেন জমা দিতেই পাসপোর্ট ফেরত দিল। ভিসা দেয়া হয়নি... রিজেক্টেড ... (চলবে)

Thursday, January 6, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৩


কিন্তু সৌদি আরব আসাটা এত সহজ হয়নি। ইউনিভার্সিটি হতে ভিসা এডভাইজিং পেপার ঢাকা’র সৌদি এ্যাম্বাসি পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে বলা হলো এ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করতে। একদিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে এ্যাম্বাসিতে গেলাম। কিউ কমই ছিল। শিক্ষক/ডাক্তার ছাড়া নতুন ভিসা বন্ধ। যারা ছিল তারা মূলত দেশে ছুটিতে এসেছে, এখন কাগজপত্রের ঝামেলা, মেয়াদ শেষ – ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিছু নেপালি লোককেও দেখলাম। ...

আমার ফুরফুরে মেজাজ বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না। এ্যাম্বাসির গেটের সিকিউরিটি গার্ডদের হুমকি ধামকি খুব অপমানজনক মনে হচ্ছিল।সাধারণ বাংলাদেশি গার্ডদের কর্তা ব্যক্তিদের মত আচরণ খুব সহজেই আমাদের প্রবাসি রেমিটেন্স প্রদানকারিদের (GNP’র মূল contributor)অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলে।

আমাকে অবশ্য তেমন কিছুই বললো না, শুধু চোখ তুলে তাকাল। হয়তো আমার শরীরের পোষাকই এর কারন। ছোটবেলায় পড়া পারস্য কবি শেখ সাদী’র গল্পটি মনে পড়ে গেল...

হয়তো তোমার অনেক ক্ষমতা
উল্লাসের কী আছে তাতে?
চাটুকারি করে জমানো বিত্তের চেয়ে
ঢের ভাল গায়ে খেটে খাবার জোটানো।
                     --- শেখ সাদী

ভেতরে একটু একটু করে কাউন্টারের দিকে এগুচ্ছি, লম্বা লিকলিকে দু’মুষ্ঠি দাড়িঅলা এক লোক সবাইকে বকছে, কারো কথাই ভালোভাবে শুনছেনাপরে জেনেছিলাম ওনার নাম “রমজান অথবা ঈমান আলী”, সৌদিদের চেয়েও বড় “সৌদি”আসলে যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। কোথায় আমাদের লোকদের সাহায্য করবে, তা না- খুব খারাপ আচরণ করে।

নেপালিদের আলাদা একটা লাইন দেখলাম। ব্যাপার কী? ... তারা এখানে কি করে? কথা বললাম একজনের সাথে। তারা আক্ষরিক অর্থেই বস্তা ভরে পাসপোর্ট এনেছিল। নেপালে সৌদি এ্যাম্বাসি নেই, বাংলাদেশের মাধ্যমে কার্যক্রম চালায়।
কষ্ট লাগলো, আমাদেরকে ভিসা বন্ধ করে দিয়ে সৌদি এ্যাম্বাসি নেপালি ভিন্নধর্মীদেরকে ভিসা দিচ্ছে, তাও আমাদের দেশে বসে ... আমরা কতটুকু আস্থা হারিয়েছি তাদের কাছে ... ভাবনার বিষয়।

আমি কাউন্টারে গিয়ে আমার কাছে ইমেইল এ আসা ভিসা এডভাইজিং পেপারটা দিলাম। লোকটি ভেতরে চলে গেল, ২ মিনিট পর জানাল আমার নামে কোন পেপার আসে নাই। আমার ব্যাপারে তাদের কিছু করার নাই ... ফুরফুরে মেজাজের এই আমি নিমিষেই ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম ... (চলবে) ...