Thursday, April 14, 2011

সৌদি আরব ডায়েরি -১১ (অপারেশন ফিফা টাউন, রেড সি ও মান্দি কথন)

শম্পা ভাবী বেশ কিছুদিন ধরেই কোথাও ঘুরতে যেতে চাচ্ছিলেন। আমাদেরকে জানানোর সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেলাম। এসব ব্যাপারে আমার আবার “না” নেই। প্রথমে রেড সি’র একটা বীচ ঠিক করা হলো, যেখানে তাবুতে রাতে থাকবো, মাছ ধরবো আর সারারাত ধরে পূর্নিমা উপভোগ করব। ১৯শে মার্চ (২০১১) চাঁদ পৃথিবীর খুব নিকটবর্তি ছিল, সে রাতটিই আমরা ঠিক করেছিলাম। পুরো প্রোগামটি কোর্ডিনেট করার কথা ছিল ইশরাতের। কিন্তু সময় গেলে দেখা গেল কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করা ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। ... কি আর করা প্রোগ্রাম বাতিল। ঘরের বারান্দায় বসেই ১৯ শে মার্চের পূর্নিমা উপভোগ করলাম।

১৯শে মার্চের (২০১১) চাঁদ

... ভাবী কিন্তু থেমে নেই। ঠিক করলেন সেমিস্টার ব্রেকে তায়েফ ঘুরে আসব। মহানবী (সাঃ) এর স্মৃতিবিজরিত অনেক চিহ্নই সেখানে আছে। কিন্তু আমাদের এখান হতে অনেক দূরত্বের করনে এবারের মতো তা বাদ দেয়া হলো। গাড়িতে আসা যাওয়া একটু কষ্টের হয়ে যাবে।


একদিন বিকেলে ভাবী ফোন করে জানালেন আমরা Fifa/Faifa Town ঘুরতে যেতে পারি। আদিল ভাইয়ের এক স্টুডেন্ট নাকি ফিফা টাউনের কথা বলেছে- চমৎকার টুরিস্ট স্পট। আদিল ভাই নেটে সার্চ দিলেন, দারুণ সব ছবি পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম বৃহঃবার সকালে রওনা হব।



Faifa Town

গাড়ী ঠিক করা হলো। একসাথে ৯ জন যাওয়া যাবে। এর মাঝে শাহরিয়ার ও হাবিব ভাই কিভাবে যেন জেনে গেল আমরা উইকেন্ডে ঘুরতে যাচ্ছি। তারাও আমাদের সাথে যেতে চাইলো। রাতে আমি ও মিলন একসাথে হলাম। কি করা যায় ... মনির ও জুঁই মাহাইল থাকলেও আমরা তাদেরকে ছাড়া ফিফা টাউনে যাবার কথা ভাবতেও পারিনা। মনির থাকা মানেই আনন্দ বহুগুনে বেড়ে যাওয়া। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল... আমি, মনির, মিলন ও আদিল ভাই’র ফ্যামিলিতে ৮জন, শাহরিয়ার ও হাবিব ভাই সহ ১০ জন। ১জনকে নেয়া যাবেনা। ... অনেক চিন্তা’র পর মোটামুটি ধারনা করলাম শাহরিয়ার ভাই নিশ্চিত ভাবেই যাবেনা। সে বিভিন্ন জনকে প্রায়ই ঘুরতে যাবার কথা বলে রাখে, হয়ত একসাথে ৩ জনকে- তারপর সুবিধাজনক অপশনটি বেছে নেয়।... তাই হলো- পরেরদিন (বুধবার) জানতে পারলাম উনি যাবেননা, আরেক জায়গায় প্রোগ্রাম আছে। শেষ দিন না বলে উনি এ কথাটি আরো আগেই বলতে পারতেন, আমাদের ঝামেলা কম হতো, টেনশনও করতে হতো না। ... অবশ্য আমরা কিন্তু খুশিই হলাম। সাথে সাথে মনিরকে ফোন করলাম- “তাড়াতাড়ি আসো”। ... আর ওরাও সন্ধা’র মধ্যে হাজির। শুরু হলো ম্যারাথন আড্ডা। রাত ১০টার দিকে আদিল ভাই এসে ওয়ার্নিং দিলেন- ১১টার মধ্যে ঘুমোতে যাও, সকাল ৬টায় গাড়ীতে উঠতে হবে। আড্ডা ভাঙ্গতে হলো – সকালের জন্য অপেক্ষা।



সৌদি আরবের দক্ষিণ পশ্চিমে “জিজান” প্রদেশ। ফিফা সেখানেই। আবহা/আভা হতে জিজান সিটি প্রায় ১৫০ কিমি., আর ফিফা জিজান হতে ৭০ কিমি. দূরে অবস্থিত। ফিফা ইয়েমেন বর্ডারের কাছের একটি শহর। পাহাড় চূড়ায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ২০টি গ্রামে প্রায় ৭০,০০০ লোকের বসবাস। এখানকার অধিবাসীরা কোমরে বিশেষ ধরনের ড্যাগার রাখে যা জাম্বিয়া (Jambyia) নামে পরিচিত। এ ড্যাগারটি মূলত তাদের পোশাক পরিচ্ছদের অংশ। সৌদি আরবের বাদশাহদেরকেও বিভিন্ন ছবিতে এ ধরনের ড্যাগারসহ দেখা যায়। ১৯৪০ সালে ফিফা’য় বেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় যা এখনো অনেকে স্মরণ করে থাকে।

Jambyia

ফিফা পাহাড় চূড়া’র শহর। তবে আবহা’র সাথে পার্থক্য হলো যে, ফিফা’র পাহাড় চূড়া’য় সমতল ভূমি কম। বিভিন্ন ঢালে বিক্ষিপ্তভাবে গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে। চারদিক গাছ গাছালিতে ভরা, এপ্রিলে ফুলে ফুলে ভরে যায়। বৃষ্টি এলে পাহাড়গুলো ঝর্ণা হয়ে উঠে।



আমরা সকাল ৬.১৫ তে রওনা দিলাম। হাবিব ভাইয়ের আসার কথা থাকলেও আসেননি। জিজান সমুদ্র সমতলে অবস্থিত। আবহা’র পাহাড় বেয়ে যখন নামছিলাম- গা ছমছম করে উঠে। তখনও বুঝিনি এর চেয়েও বিপদজনক জায়গায় আমরা যাচ্ছি।

পাহাড়ের ঢালে তৈরি রাস্তা

৭.৩০ এ মোসাল্লেসে থেমে নাস্তা করে নিলাম। ব্রেড, পাস্তা, চিকেন ফ্রাংক, আপেল, জুস ছিল নাস্তার আয়োজন। সবাই মিলেই ব্যবস্থা করেছিলাম। তবে যেখানে থেমেছিলাম সেখানকার চা ছিল অসাধারণ।


জিজান যেতে যেতে পথের ধারে অনেক আম বাগান আর কলা বাগান চোখে পড়ল। রাস্তার ধারে কাঁচা আম বিক্রি হচ্ছিল। ...আহা! কাঁচা আমের মুসুর ডাল কতই না মজার !!! ফেরার পথে সবাই কাঁচা আম কিনব ভেবেছিলাম, তা আর হয়ে উঠেনি।


... ড্রাইভার ফিফা চেনেনা। আমরাও জানিনা কোনদিকে যাচ্ছি। ভরসা শুধুমাত্র গুগুল ম্যাপ আর রাস্তার পাশের ইন্ডিকেটর বোর্ড। কাউকে জিঙ্গেস করেও লাভ নেই, আরবী ছাড়া কিছু বুঝে না।আদিল ভাই গুগুল থেকে ম্যাপ প্রিন্ট করে এনেছেন, আর আমি মাঝে মাঝে আমার মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটে গুগুল ম্যাপ দেখছি।


... যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, রাস্তাতো শেষ হয়না। আমি, মিলন আর মনির গাড়ীর পেছনে বসেছিলাম। এমন একটা অবস্থা পা ঠিকমতো সোজা করা যায় না। পা ব্যথা হয়ে গেল ... অবশেষে ১১.০০ এর দিকে Thwayei Mountain দেখা গেল। পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলো দেখতে ভালোই লাগছিল। প্রায় ৪০০০ ফিট উচু Thwayei Mountain। আমদের গাড়ী উঠতে থাকলো। কিছুদূর যাবার পর আমারা ভয় পেতে শুরূ করলাম।


পাহাড়ের গায়ে চিকন রাস্তা, কোনমতে ২ টি গাড়ী আসা যাওয়া করতে পারে। রাস্তাটি প্রায় ৪৫ ডিগ্রি খাড়া। মাঝে মাঝেই বাক নিয়েছে। ২বার গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল, ড্রাইভার তাড়াতাড়ি সামলে নিল। কিছু হলেই সোজা নীচে গড়িয়ে পড়তে হবে। বাক নিতেই দেখা যায় সামনে হতে গাড়ী আসছে... আত্মা বের হয়ে যাবার মতো অবস্থা।




ভেবেছিলাম অনেক ছবি তুলব, এখন ফেরত যেতে পারলেই বাঁচি। আধাঘন্টা চলার পরেও চূড়ায় উঠতে পারলাম না, এদিকে গাড়ীর উপরে উঠতেও সমস্যা হচ্ছিল। টায়ার পোড়া গন্ধ বের হলো, আমরা কেউই আর সামনে যেতে চাইলাম না। আল্লাহ আল্লাহ করে নীচে নেমে আসলাম। ড্রাইভার পরে স্বীকার করেছে যে সেও প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। অথচ লোকাল লোকগুলো কত সহজেই গাড়ী চালিয়ে উপরে উঠছে ... (চলবে)

সৌদি আরব ডায়েরি -১০ ( খাবার দাবার প্রসঙ্গ-২, তমিজ এবং খেবসা'র রেসেপি )

একদিন সন্ধ্যায় কনকনে ঠান্ডায় বের হলাম। বেশ বাতাস ছিল। বিকেল থেকেই মন চাচ্ছিল বাহিরের কিছু একটা খাই। ... প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে এক আফগান দোকানে গেলাম ... বড় একটা তন্দুরে রুটি বানাচ্ছিল- আমদের দেশের কমপক্ষে ৮ টা তন্দুর রুটির সমান। এখানে রুটিটাকে "তমিজ" বলে। ১টা রুটি ৩ রিয়াল রাখলো। সাথে ১ বাটি "ঘন মুসুর ডাল" আর ১ বাটি "ফুল" নিলাম মাত্র ২ রিয়ালে।"ফুল" হচ্ছে এক ধরনের Kidney বীন পিষে বানানো কারি।
তমিজ ঠান্ডা হয়ে গেলে খাওয়া যায়না, গরম থাকতেই খেতে হয়। ফুল দিয়ে যখন তমিজে'র একটা টুকরো মুখে দিলাম... মনে হলো, আহ! একেবারে বেহেশতী খানা।


আমরা দুজনে মিলেও ১টা তমিজ শেষ করতে পারিনি।

সৌদিতে খেপসা/খেবসা খুব জনপ্রিয়। কারো বাসায় দাওয়াত থাকলে খেবসা থাকবেই। খেবসা মূলত ইয়েমেনি খাবার, তবে গলফ দেশগুলুতে সবাই এটা পছন্দ করে। খেবসা হচ্ছে বাসমতি চাল ও বিশেষভাবে তৈরি মাংসের মিশ্রন। চিকেন, বিফ, মাটন এমনকি মাছ দিয়েও খেবসা তৈরি করা হয়।



কখনও ভাবিনি ব্লগে খাবারের রেসেপি দেব। কিন্তু আমার আগের লেখা খাবার দাবার প্রসঙ্গ-১ এ দেখলাম আমার মতো অনেকেই ভোজনরসিক, নতুন খাবারের স্বাদ নিতে চান। তাই খুব সাধারণভাবে ঘরে কিভাবে খেবসা বানানো যায় তা তুলে দিলাম। বলে রাখা ভালো রেসেপিটি একটু বাংলাদেশি স্টাইলে করা। তবে আমাদের কাছে স্বাদ আসল সৌদি খেবসা'র মতোই লেগছে।

উপকরণঃ (৩ জনের জন্য ... খেবসা মজাদার খাবার, তাই বুঝতেও পারবেননা কখন বেশী খেয়ে ফেলেছেন। খাবার কম পড়লে দায়ী করবেননা)


১। সেদ্ধ চাল – আধা কেজি (এখানে চালটা বেশ লম্বাটে ধরনের, বাংলাদেশে লম্বাটে বাসমতি চাল খুজে দেখতে পারেন—তবে রান্না'র পর ভাত ঝরঝরে থাকতে হবে, ভাত গলে যায় এমন চালে হবেনা)

২। মুরগীর মাংস – ৮ পিস (অবশ্যই চামড়া সহ হতে হবে,চামড়া সহ মাংসেই আসল মজা)
৩। আদা, রসুন, পেয়াজ বাটা -পরিমান মতো
৪। রসুন, পেয়াজ, কাঁচামরিচ, টমেটো কুচি করা-পরিমান মতো
৫। আস্ত জিরা এবং জিরা, ধনিয়া, গোলমরিচ গুড়ো-পরিমান মতো (হলুদ ও মরিচের গুড়ো দেওয়ার প্রয়োজন নেই, যারা ঝাল খেতে চান কাঁচামরিচ বেশী করে দিবেন)
৬। তেল, লবণ, তেজপাতা ও গরম মশলা-পরিমান মতো

ছুটির দিনের সকালে আয়েশ করে বিছানায় চোখ বুঁজে ছিলাম আর চিন্তা করছিলাম দুপুরে ব্যতিক্রমি কি খাওয়া যায়। ওয়াইফকে বলায় সে বললো খেবসা রান্না করা যায়। কয়েকজনের সাথে আলাপ করে আগেই রান্নার প্রণালী জেনে নিয়েছিলাম। ঘরে সবকিছুই ছিল, শুধু খেবসা'র চাল ছিলনা।

আড়মোড়া ভেঙ্গে দোকানে গেলাম চাল আনতে


খেবসা'র চাল –"আবুকাস", লম্বাটে ধরণের

মাংস কাটা হলো চামড়া সহ ...

প্রথমে গরম তেলে গরম মশলা, আস্ত জিরা ও তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে নিন। তারপর সমস্ত গুড়ো মশলা, আদা, রসুন, পেয়াজ বাটা ও রসুন, পেয়াজ, কাঁচামরিচ, টমেটো কুচি একসাথে ভালোভাবে গরম তেলে কষান/ভাজুন। পরিমানমতো লবণ দিন।

অপর একটি পাত্রে সাধারণভাবেই ভাত রান্না করতে থাকুন...

মশলা কষানো হয়ে এলে তাতে মাংস ঢেলে দিন …৮/১০ মিনিট ঢেকে রাখুন। পানি দেয়া লাগবেনা।


মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবার কথা। এবং অপর পাত্রের ভাতও হয়ে যাবে। ভাতের পানি আঠালো হয়ে আসলে মাংসের পাত্রে তা সম্পূর্ণ ঢেলে দিতে হবে।

একটা জিনিষ খেয়াল রাখতে হবে যেন পানিটা পরিমান মতো হয় এবং ভাতের মাড়ে আঠালো ভাবটা চলে আসে।

আঠালো একটা রস তৈরি হয়ে গেছে ... এই গ্রেভিটাই খেবসা'র মূল স্বাদ। গ্রেভি ভাবটা না থাকলে খিচুরি বা চিকেন বিরানী'র সাথে পার্থক্য থাকবেনা।

হাল্কা আঁচে রেখে দিন।পানি শুকিয়ে খেবসা তৈরি হয়ে গেল। তবে গ্রেভিভাবটা কিন্তু রয়ে গেছে।

… সালাদ কাটুন

… হয়ে গেল মজাদার খেবসা

… আয়েশ করে খান লাবান সাথে নিয়ে। যারা বাসায় রান্না করবেন আশা করবো এখানে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ভুলবেননা।

নোটঃ ধন্যবাদ মেকানিক, কঠিন লজিক, পারাবত,দ্যা ডক্টর ভাইদেরকে। যারা প্রথম পর্বে নতুন নতুন অনেক খাবারের সন্ধান দিয়েছেন। আমার মতো ওনারাও জাঁদরেল ভোজনরসিক।

সৌদি আরব ডায়েরি -৯ (ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ)

আলী এমবিএ করছে। সে চমৎকার ইংরেজি বলে।সাধারণত সৌদিদের, বিশেষ করে স্টুডেন্টদের কাছ হতে এত ভালো ইংরেজি শুনিনি। জানতে পারলাম সে ইউকে গিয়ে ৬ মাসের ইংলিশ কোর্স করে এসেছে। প্রায় সময়ই সে আমার কাছে আসে।আমরা গল্প করি ... তার খুব ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে সে হোটেল বিজনেস শুরু করবে। আগেই বলেছি “আভা” একটি টুরিস্ট সিটি, তাই Summer এ এখানে Hotel Business খুব জমজমাট থাকে।আমার কাছে বিজনেস সম্পর্কে জানতে চায়, নতুন ট্রেন্ড কি, কি করলে সে একজন সফল বিজনেসম্যান হবে, ইত্যাদি।আমি বলি, সে হা করে মনযোগ সহকারে শোনে।

... একদিন সে আমতা আমতা করে বলল, “দক্তর, একটা কথা বলি?” (এখানে টিচারদের আরবিতে দক্তর/ডক্টর বলা হয়; মাঝে মাঝে মজা লাগে- PhD না করেও ড. হয়ে গেছি) আমি বললাম, অবশ্যই; ভাবলাম হয়তো নতুন কিছু জানতে চাইবে।

--- “তোমরা বাংলাদেশিরা তো ভালো না, তবে আমার ভাগ্য ভালো যে তুমি অন্য সবার মতো নও” (You, Bangladeshi people are not good. I am lucky that you are not like others.)
ততোক্ষণে আমার চেহারা ‘লাল’ হয়ে গেছে; কোনমতে বললাম, কেন?
--- “তোমরা সৌদি আরবে চুরি করো, মানুষ মেরে ফেল, রেপ কর, সব সময় ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো, তোমাদেরকে কেউ পছন্দ করে না...”

আমি অল্প ক’দিন হলো এখানে এসেছি, এখনও অনেক কিছু বুঝার বাকী আছে। আলী একজন শিক্ষিত ছেলে- সে এভাবে চিন্তা করছে, প্রকৃতপক্ষে ব্যপারটা জানি কতটা ভয়াবহ। সে আরো বলল- “তোমাদের Government কেন শিক্ষিত লোক পাঠায় না? অশিক্ষিত লোকেরা এখানে মাসে ৩০০ রিয়াল বেতনে জব করে, আর অবৈধ কাজ করে বেশী রিয়াল পেতে চায়।”

সে তার লেপটপ আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল। ইউটিউবের একটা ভিডিও (http://www.youtube.com/watch?v=সঙ্গত
কারনেই লিংকটি সরিয়ে ফেললাম) চলছে। আমার মাথা হেট হয়ে এল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার দেশের মানসন্মান ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে ... ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা, তাড়ণা অনুভব করছিলাম তার ভুল ভেঙ্গে দেবার জন্যে। অল্প সময়ের মাঝে চিন্তা করলাম কি বলা যায়। ৩ টি পয়েন্ট তার সামনে তুলে ধরলাম।

১. ইন্ডিয়ান’রা এখানে সাংগঠনিকভাবে বেশ গোছাল। তারা অপকর্ম করে বাংলাদেশিদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়। ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব পত্রিকা আছে, তারা সবসময় বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে প্রোপাগেন্ডা চালায়। সৌদিরা এত কিছু না বুঝেই বিভিন্ন ঝামেলায় বাংলাদেশিদের দায়ী করে, অনেকটা prejudiced।
কলকাতার লোকেরা অপকর্ম করে নিজেদের বাংগালী বলে পরিচয় দেয়, আর সৌদিরা ধরে নেয় সে বাংলাদেশি।

২. মায়ানমার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এখানে আসছে, এবং সংখ্যাটা অনেক। আমি স্বীকার করলাম এটা বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা। রোহিঙ্গারা অপকর্ম করলে বাংলাদেশের নাম হচ্ছে।

Click This Link


৩. সত্যিই কিছু বাংলাদেশি আছে যারা খারাপ কাজে লিপ্ত। তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি হওয়া উচিত।


মনে হলো আলী কিছুটা বুঝতে পারলো। ইউটিউব হাতড়ালাম – তাকে Beautiful Bangladesh, Dr. Muhammad Yunus এর Social Business এর উপর clips দেখালাম। বললাম, YouTube এর একজন হচ্ছে বাংলাদেশি জ়ায়েদ করিম। সে অবাক হয়ে দেখলো, শুনলো। বাংলাদেশে এত সুন্দর! এমন লোকও আছে! আগেতো সে তা জানেনি ...


আলী’র কাহিনী এখানেই শেষ ... আলী’র মতো পৃথিবী’র বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক লোক আছে যারা বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ভ্রান্তি’র মধ্যে আছে। বাংলাদেশের অর্জনগুলো তাদের কাছে পৌছেনি। আমরা বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং কী দিয়ে করবো? ২১ শে ফেব্রুয়ারি International Mother Language Day- অথচ বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতদের কোন ভূমিকাই নেই, তারা জানেনা কখন কি করতে হবে। আমাদের দেশের খুনীরা হয় রাষ্ট্রদূত।“পাট” – সেতো সোনালী অতীত। সিলেট, কক্সবাজার অথবা সুন্দরবনকে কি আমরা সেভাবে তুলে ধরতে পারছি?

কী দিয়ে আমরা ব্র্যান্ডিং করবো?


ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেদিন নোবেল পুরষ্কার পেলেন, সারা পৃথিবী জেনে গেলে বাংলাদেশের কথা। মানুষ যতবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানলো, তার চেয়েও বেশী জানলো বাংলাদেশকে। কয়েকদিন আগে আমার এক বড়ভাই ফেসবুকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি YouTube Clip শেয়ার করলেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনলাম তার Social Business এর কথা। কতটা জৌলুস তার বক্তৃতার মাঝে। বাংলাদেশে কি আর একজন ব্যক্তি আছে যে এত চমৎকারভাবে ইংরেজিতে বলতে পারবে? সবাইকে মোটিভেট করতে পারবে?
সারা পৃথিবী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানে, জানে আমাদের এ দেশটাকে। আজ আমরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে নামাচ্ছি, তাতেও বোধয় শান্তি পাচ্ছিনা। আজ আমরা হিসেবের খাতাপত্র খুলে বসেছি। হিসাব কষছি- ব্যক্তি ইউনূস কতটুকু পেল, খুঁজে বের করছিনা বাংলাদেশ কতটুকু পেল।

একবার বিরিশিরি গিয়েছিলাম বেড়াতে। কথায় কথায় গ্রামের মানুষদের জিঙ্গেস করি গ্রামীন ব্যাংকের কথা, ব্র্যাকের কথা। তাদেরকে অসহায় মনে হলো। তারা আগে কখনও ঋণ কি জানতোনা, এখন তারা ঋণের চাপে জর্জরিত। তারা নতুন ঋণ পায় পুরুনো ঋণ শোধ করার জন্য। আছে উচ্চ সুদ। তার মাঝে অনেক ব্যতিক্রমি সফল মানুষও আছে।


কিন্তু উপরের YouTube Clip টিতে যেভাবে Microcredit এর ধারণা আছে, তাতে কিন্তু গরীব লোকদের সফল হবারই কথা। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো আমাদের কথা ও কাজে মিল নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন একরকম, কিন্তু হয়তো করেছেন আরেক রকম।


... তারপরেও আমি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দোষ দেই না। তিনি আমাদের দিয়েছেন অনেক। আমরা তাকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে তার ভুলটুকু শোধরাতে পারতাম। এখনো তার অনেক কিছু দেয়ার আছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। উনি বলেছিলেন, (হুবুহু এরকম নয়) একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠে প্রথম প্রজন্মের দূর্নীতির উপর ভিত্তি করে, ইউরোপের শিল্প বিপ্লব দূর্নীতির ফসল- আজ আমরা তার সুফল ভোগ করছি ...


আমাদের দরকার যোগ্য নেতৃত্ব, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্ব- যারা আজীবন দেশের জন্য কাজ করে যাবেন। যাদেরকে কোন প্রকার বয়সসীমা দিয়ে আটকে রাখবোনা। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং অবশ্য একদিক দিয়ে হয়েই আছে। শেখ হাছিনা আর খালেদা জিয়া’র প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে খুব দ্রুতই পরিচিত করে তুলছে। তাদের বোধয় অবসরে যাবার বয়সসীমা নেই !!!


বিশেষ নোটঃ

আজ (মার্চ ১৫) সামহয়ারইনব্লগে একটা YouTube Clip পেয়ে গেলাম। খুবই interesting মনে হলো। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাছ হতে প্রথম ঋণ গ্রহনকারি সুফিয়া বেগমের কথা জানি, আরো জানি তিনি মারা গেছেন- নিঃস্ব অবস্থায়। কিন্তু এই YouTube Clip দেখাচ্ছে সুফিয়া বেগম এখনও বেঁচে আছেন।

Wednesday, March 2, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৮ (আল হাবালা- The Hanging Village)


মনির ২ মাস আগে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে। কিন্তু তার পোস্টিং আভা’তে হয়নি, হয়েছে মাহাইল (Mahail) ক্যাম্পাসে । মাহাইল আভা’র মতো ঠান্ডা জায়গা নয়, বেশ গরম- ৩০ ডিগ্রির উপরে। সেখানে ৩/৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষক আছেন, কিন্তু তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। মনির নিঃসঙ্গ হয়ে গেল, ক্যাম্পাস, বাসা, টুকিটাকি বাজার- এই করেতো সময় কাটেনা। সে আমাদের মিস করতে থাকলো ... আমাদের বন্ধুদের আড্ডা বলে কথা!

তবে এরই মাঝে একটা সুযোগ হল ... সৌদি বাদশাহ স্বাস্থ্য উদ্ধার করে দেশে ফিরছেন, সারাদেশে আনন্দ। সেই আনন্দে শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি)ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে শোনা যায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে গণআন্দোলন দেখে, উনি অবকাশ যাপন কেন্দ্র থেকে কিছুটা তড়িঘড়ি করেই দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই সবাইকে খুশি করতে ৩৬০০ কোটি ডলারের সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেন।


আমাদের বৃহঃপতি ও শুক্রবার ছুটি, শনিবার মিলিয়ে টানা ৩ দিনের ছুটি হয়ে গেল। মনিরও বেশী দেরী করা সমিচীন মনে করেনি। বুধবার বিকেলেই জুঁই’কে (ওয়াইফ) নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির। আমরাও খুশীতে আটখানা, ও থাকলে আড্ডাটা বেশ জমে উঠে। সে রাতে ৩টা পর্যন্ত আড্ডা হলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম “আল হাবালা” ঘুরতে যাব।


হাবালা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। আভা হতে ৪০ মাইল দূরে চমৎকার একটি টুরিস্ট স্পট। হাবালাকে বলা হয় ঝুলন্ত গ্রাম/দড়ি’র গ্রাম (Hanging Village/Village of Rope)। ১৯৭০ সালে মাইনিং রিসার্চ সেন্টারের একটি দল হেলিকপ্টারে অনুসন্ধানের সময় অদ্ভুত এই গ্রামটি দেখতে পায়। পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত একটি গ্রাম। পাহাড়ের মাথা হতে ৪০০ মিটার নীচে পাহাড়ের ফাঁটলে গ্রামটি গড়ে উঠেছিল। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে চলাচল বা বের হবার কোন উপায় ছিলনা, চারদিকই ছিল পাহাড় বেস্টিত। যোগাযোগে একমাত্র উপায় ছিল দড়ি বেয়ে পাহাড়ের মাথার দিকে উঠা। প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দড়ি’র মাধ্যমে নামানো হতো। খুঁজে পাবার পরে গ্রামবাসীদেরকে কিং ফয়সাল ভিলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। কেন তারা ওখানে ছিল? আগেই বলেছি, এ অঞ্চল একসময় তুর্কিরা শাসন করতো। আসির প্রদেশে (আভা হলো আসির প্রদেশের রাজধানী)কাহতানিরা (Qahtan Tribe) সবসময় প্রভাবশালী। সময়ক্রমে কাহতানিরা তুর্কিদের এ অঞ্চল হতে তাড়িয়ে দেয়। তুর্কিদের শাসনামলে নিরাপদে থাকার জন্যেই কাহতানিদের একটি গ্রুপ এখানে আবাস গড়ে।

পরবর্তীতে একে টুরিস্ট স্পটে পরিণত করা হয়। এখানেই আছে সৌদি আরবের ১ম কেবল কার। ৬০০ মিটার দীর্ঘ কেবল কারে করেই নীচের গ্রামটিতে নামতে হয়।


আল হাবালা- The Hanging Village

... তো বৃহঃপতিবার বিকেল ৩ টায় আমি ও শাকিলা, মনির ও জুঁই, মিলন ও লিজা, দিবা ও তার আব্বা এবং ইশরাত, ৯ জন রওনা দিলাম হাবালার উদ্দ্যেশে।




এখন এটি টুরিস্ট স্পট


৩০ মিনিটেই পৌছে গেলাম। পাহাড়ের একটি অংশকে দেখে আমার ওয়েস্টার্ন মুভি’র কিছু দৃশ্য মনে পড়ে গেল। পাহাড়ের প্রান্তে তারের বেড়া দেয়া, নীচের দিকে তাকাতেই ঝুলন্ত গ্রামটি দেখতে পেলাম।একটা জিনিষ গুলিয়ে ফেললে চলবেনা। আভা- পাহাড়ের উপরে তৈরি একটা শহর। শুরু হলো আমাদের ছবি তোলা। মনির একজন স্বাস্থ্যবান ছেলে, যে কোন ছবি তুললেই তার ৯০% জায়গা জুড়ে সে থাকে। মিলন ও লিজা কিছু রোমান্টিক ছবি তুলল। আমরা দু’জনও বেশ কিছু ছবি তুললাম-ভদ্র ছবি। ইশরাত একা ছিল, ছবি তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহও ছিল বেশ। কি আর করা ! আমি অনেকগুলো ছবি তুলে দিলাম।তবে আমার আগ্রহ ছিল প্রকৃতির দিকে। মরুর বুকে এতো চমৎকার কিছু ফুল ফুটে ছিল যে বার বার অবাক হচ্ছিলাম কিভাবে এগুলো বেঁচে আছে। এতো সতেজ আর মোহময়ী।



অনাদরে বেড়ে উঠা ...

সামনেই কেবল কার স্টেশন, ভেতরে ঢুকতেই কৃত্রিমভাবে লাগানো ফুল চোখে পড়ল। একটা জবা গাছও দেখলাম।




বাগানে লাগানো ...

টিকেট কাটতে গিয়ে দেখলাম দু’জন বাংলাদেশি ভাই টিকেট বিক্রি করছে। টিকেটের দাম জনপ্রতি ৪০ রিয়াল। উনারা আমদের ডিসকাউন্ট দিলেন, ৩০ রিয়াল করে রাখলেন। এই প্রথম কেবল কারে চড়ছি, আমার ধারনা ছিল কেবল কার হরিজন্টাল পথে চলে। কিন্তু এটা পাহাড়ের উপর হতে নীচে নামছে, ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে। জুঁইতো ভয়ে চোখ বন্ধ করলো আর মনিরকে খাঁমচে ধরলো। নীচে সবকিছু সাজানো গোছানো, ভালো লাগলো। মনেই হয়নি মরুভূমিতে আছি ... চারিদিকে গাছের জঙ্গল- বাংলাদেশের মতো সবুজ। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, দৌড়ে বেড়ালাম।


কেবল কার, নীচে নামছে

কেবল কার লাইন

উপর হতে দেখা ...

অনেক সাজানো গোছানো

ফণীমনসার ঝোপ

মেয়েরা আবিষ্কার করলো এখানে কিছু ‘জিরা গাছ’ জন্মেছে, আমরা ঘ্রাণ নিলাম। এখানে সেখানে কিছু ভাঙ্গা ঘর/বাড়ি ছিল, আগের দিনের বসতি। বেশ কিছু সৌদি ফ্যামিলিও ঘুরতে এসেছিল, তারা অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। ওখানে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানেও এক বাংলাদেশি। ড্রিঙ্কস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে বাসার পথে...


খাবারের জন্য অপেক্ষা ...

ড্রিঙ্কস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই

বাসার পথে...
বাসায় আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। রাতে আমাদের বাসায় মনির আর মিলনদের খাবার দাওয়াত ছিল। কিছুই করা হয়নি। বাজার করে রান্না শেষ হতে হতে রাত ১১ টা। খিচুরি, মুরগির মাংস, সর পুটি আর হামুর মাছ (সী ফিশ) খেলাম তৃপ্তিভরে। তারপর ম্যারাথন আড্ডা, মনির আসর জমিয়ে রাখলো তার মতো করেই। রাত ৩ টা বেজে গেলেও কেউই তো উঠতে চায়না, শেষ পর্যন্ত জোর করে তাদের বের করতে হলো।


দি এ টিম ...

Saturday, February 26, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৭ ( খাবার দাবার প্রসঙ্গ )

এখানে আসার পর খাবার দাবার নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয়নি। বাসা হতে বের হলেই শাক/সব্জি’র দোকান।

আর তা বেশিরভাগই বাংলাদেশীদের। আমি ভোজন রসিক, ডাল আর শাক/সব্জি খুব পছন্দ করি। শম্পা ভাবী তা জানেন, তাই শম্পা ভাবী দাওয়াত করলে ধরে নেই ডাল থাকছেই। আমার স্ত্রীও তিন ধরণের ডাল (মুসুর, মুগ, মাসকলাই)মিক্স করে চমৎকার ভূণা করে ... খেতে এককথায় অমৃত। সেই আমি যদি দেখি দোকানে থরে থরে শাক/সব্জি আর ডাল সাজানো, খুশীতো হবই ।

প্রথম যেদিন সব্জি কিনতে গেলাম – অবাক হলাম। কি নেই? ... লাল শাক, পালং এর মতো শাক, কচু’র মুখী/লতি, পটল, কাকরোল, কুমড়া, আলু, শাজনা, বরবটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ... আরো কত কি, সবতো মনেও নেই। এমন কিছু সব্জি ছিল যার তখন বাংলাদেশে সিজন না। জানতে চাইলাম কোথা থেকে আসে সব্জিগুলো... আভা’য় বাংলাদেশীরা ক্ষেত (আরবিতে “মাজরা” বলে)করে, এখানকার মাটি খুব উর্বর, ফলে সব ধরনের সব্জিই এখানে হয়। প্রথমদিনই ব্যাগ ভর্তি করে শাক/সব্জি নিয়ে আসলাম। পালং এর মতো শাকটি যে এতো মজা হতে পারে, খাওয়ার আগে ধারণা ছিল না।

দেশ হতে আসার সময় ইলিশ মাছ আর হাসের মাংস নিয়ে এসেছিলাম।এখানে পাই কিনা সন্দেহ ছিল। মাছ কিনতে গিয়ে সে ধারণাও ভাঙ্গলো... বড় বড় ইলিশ মাছ শুধু কলকাতাতেই যায় না সৌদিতেও আসে। মাছগুলো বাংলাদেশ হতে প্যকেটজাত হয়ে আসে। আঁশসহ ও পরিস্কার করা দু’ধরণের মাছই পাওয়া যায়। শাকিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক মাছ পরিস্কার করা নিয়ে ভাবতে হবে না। একদিন কাচকি মাছ খেলাম... আহ !!


সৌদি আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে বাংলাদেশী খাদ্যপণ্যের বিশাল বাজার। প্রাণে’র মুড়ি/চানাচুর, রাধুনি’র মশলা প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশিদের দেখলাম ছোট দোকান দিয়েই খুশি, কেননা বড় স্টোরগুলো বেশির ভাগই ইন্ডিয়ানদের।


এখানে খাবারের দাম আমার কাছে সস্তাই মনে হয়েছে। সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে “খবুজ”- এক ধরনের রুটি, বাংলাদেশের তুন্দুল রুটির মতোই প্রায়। মাত্র ১ রিয়ালে ৬ টি খবুজ পাওয়া যায়। আমি অল্পদিনেই এর প্রেমে পড়ে গেলাম। ডাল ভুনা অথবা মুরগির মাংস দিয়ে খেতে আমার দারূণ লাগে। আদিল ভাই আবার খবুজ় খেতে পারেননা, তাই উনাকে মোটিভেট করার জন্য প্রায়ই উনার সামনে খবুজের গুনগান করি... আমার রসালো খাবারের বর্ণনা দেই। উনার কথা হলো “খবুজ মাইনষে খায়? ভ্যাপসা গন্ধ করে”।


আরেকটি জিনিষ আমার পছন্দ- “তামিয়া মোশাক্কেল”। দূর্ভাগ্যক্রমে আদিল ভাই আর মিলনের এটা পছন্দ না। তবে আদিল ভাইয়ের কাছে নাকি এখন ভালো লাগছে। মিলনতো বলে, “এটা কোনো স্মার্ট খাবার না, শরীর না বাঁচিয়ে এটা খাওয়া যায় না”।তামিয়া মোশাক্কেল খেতে গেলে মুখে হয়তো সস লেগে যাবে, জামা’র উপর ভাঙ্গা অংশ পড়বে- মানে ঝামেলা হবেই। তামিয়া মোশাক্কেল পাওয়া যায় ২ রিয়ালে। অর্ধেক খবুজের ভেতর ডিম ফালি, শষা, টমেটো, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পিয়াজু, সস ও মেয়োনেজ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটা মূলত একধরণের মিক্সড স্যান্ডউইচ।


প্রথম যখন উমরার জন্য গেলাম, ডিনারের জন্য গাড়ী থামালো মরুভূমিতে, একটা রেস্টুরেন্ট, মসজিদ আর অল্প কিছু দোকানপাট। আশে পাশে লোকালয় নেই। অথচ রেস্টুরেন্টে জমজমাট অবস্থা। অবাক ব্যপার সবাই রেস্টুরেন্টের ভেতরে নয়, বাহিরে বসে আছে। ভেতরে চেয়ার, টেবিল থাকলেও তা ফাঁকা। বাহিরে ছোট ছোট ৩ বর্গফিটের গদি মোড়ানো জায়গা, হেলান দেবার জন্য কোল বালিশ, হুক্কা, আলাদা টেলিভিশন। পরিচিতদের নিয়ে সৌদিরা এমন গদি মোড়ানো জায়গায় আড্ডা দেয়, খায় দায়, হুক্কা টানে। এমন ১০/১২ টি স্পেস দেখলাম।


আমারা খাবারের অর্ডার দিতে গেলাম। সবাই আরবি বলছে, কিছুই বুঝাতে পারলাম না। খুঁজে একজন বাংলাদেশিকে পেলাম। এই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। যা জানলাম তাতে হতাশ হলাম, বাংলাদেশি খাবারের কাছাকাছি কিছু নেই। উনি আল-ফাহাম খেতে বললেন।


বড় থালায় বিশেষ ধরনের রান্না করা ভাতের মাঝখানে ঝলসানো মুরগী। বুঝতে পারলাম না কিভাবে খাব। শুকনো আর খটখটে। একটু মজাও লাগলোনা। খেতে পারলাম না। বাহিরে এসে দেখি সৌদিরা ছোট ছোট স্পেসগুলোতে বিশাল বড় থালার চারপাশ ঘিরে মজা করে ৫/৬ টি মুরগী সহ আল-ফাহাম খাচ্ছে। আমার মনে হলো সৌদিরা খাবারের বেশ অপচয় করে, অল্প কিছু খেয়ে ফেলে দেয়। আর তারা নোংরা, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, হয়তো গাড়ী দিয়ে যাচ্ছে- পেপসির বোতলটা রাস্তার মাঝখানেই ফেলবে। বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নকর্মীরা আছে বলেই রক্ষা।


... তো উমরা হতে এসে আল-ফাহাম না খেতে পারার ঘটনাটা সবাইকে বলছিলাম... আদিল ভাই লাফ দিয়ে উঠলেন –“আরে বলো কি ঐটাইতো মজার খাবার...” ... চমকিত হলাম, আমার যেটা অপছন্দ সেটাই নাকি আদিল ভাইয়ের আর ভাবী’র সেরা। প্রসঙ্গতঃ আদিল ভাই প্রতি শুক্রবার দুপুর এবং রাতের খাবার সারেন আল-ফাহাম দিয়ে।


ঘটনাচক্রে আমার এক কাজিন একদিন তার বাসায় আমাকে দাওয়াত করলো, গিয়ে দেখি আল-ফাহাম রান্না হয়েছে। ভাগ্যবুঝি একেই বলে !!! তবে রান্নাটা বাংলাদেশি টাইপ হয়েছিল এবং ভালো লেগেছিল। সবাই মিলে সৌদি কায়দায় আল-ফাহাম খেলাম। সবাই একে অপরকে বেশী বেশী ঠেলে দিচ্ছিল।একসাথে খাওয়ার মজা বুঝি এটাই। (চলবে)



কাজিনের রান্না করা আল-ফাহাম