Saturday, February 26, 2011

সৌদি আরব ডায়েরী -৭ ( খাবার দাবার প্রসঙ্গ )

এখানে আসার পর খাবার দাবার নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয়নি। বাসা হতে বের হলেই শাক/সব্জি’র দোকান।

আর তা বেশিরভাগই বাংলাদেশীদের। আমি ভোজন রসিক, ডাল আর শাক/সব্জি খুব পছন্দ করি। শম্পা ভাবী তা জানেন, তাই শম্পা ভাবী দাওয়াত করলে ধরে নেই ডাল থাকছেই। আমার স্ত্রীও তিন ধরণের ডাল (মুসুর, মুগ, মাসকলাই)মিক্স করে চমৎকার ভূণা করে ... খেতে এককথায় অমৃত। সেই আমি যদি দেখি দোকানে থরে থরে শাক/সব্জি আর ডাল সাজানো, খুশীতো হবই ।

প্রথম যেদিন সব্জি কিনতে গেলাম – অবাক হলাম। কি নেই? ... লাল শাক, পালং এর মতো শাক, কচু’র মুখী/লতি, পটল, কাকরোল, কুমড়া, আলু, শাজনা, বরবটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ... আরো কত কি, সবতো মনেও নেই। এমন কিছু সব্জি ছিল যার তখন বাংলাদেশে সিজন না। জানতে চাইলাম কোথা থেকে আসে সব্জিগুলো... আভা’য় বাংলাদেশীরা ক্ষেত (আরবিতে “মাজরা” বলে)করে, এখানকার মাটি খুব উর্বর, ফলে সব ধরনের সব্জিই এখানে হয়। প্রথমদিনই ব্যাগ ভর্তি করে শাক/সব্জি নিয়ে আসলাম। পালং এর মতো শাকটি যে এতো মজা হতে পারে, খাওয়ার আগে ধারণা ছিল না।

দেশ হতে আসার সময় ইলিশ মাছ আর হাসের মাংস নিয়ে এসেছিলাম।এখানে পাই কিনা সন্দেহ ছিল। মাছ কিনতে গিয়ে সে ধারণাও ভাঙ্গলো... বড় বড় ইলিশ মাছ শুধু কলকাতাতেই যায় না সৌদিতেও আসে। মাছগুলো বাংলাদেশ হতে প্যকেটজাত হয়ে আসে। আঁশসহ ও পরিস্কার করা দু’ধরণের মাছই পাওয়া যায়। শাকিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক মাছ পরিস্কার করা নিয়ে ভাবতে হবে না। একদিন কাচকি মাছ খেলাম... আহ !!


সৌদি আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে বাংলাদেশী খাদ্যপণ্যের বিশাল বাজার। প্রাণে’র মুড়ি/চানাচুর, রাধুনি’র মশলা প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশিদের দেখলাম ছোট দোকান দিয়েই খুশি, কেননা বড় স্টোরগুলো বেশির ভাগই ইন্ডিয়ানদের।


এখানে খাবারের দাম আমার কাছে সস্তাই মনে হয়েছে। সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে “খবুজ”- এক ধরনের রুটি, বাংলাদেশের তুন্দুল রুটির মতোই প্রায়। মাত্র ১ রিয়ালে ৬ টি খবুজ পাওয়া যায়। আমি অল্পদিনেই এর প্রেমে পড়ে গেলাম। ডাল ভুনা অথবা মুরগির মাংস দিয়ে খেতে আমার দারূণ লাগে। আদিল ভাই আবার খবুজ় খেতে পারেননা, তাই উনাকে মোটিভেট করার জন্য প্রায়ই উনার সামনে খবুজের গুনগান করি... আমার রসালো খাবারের বর্ণনা দেই। উনার কথা হলো “খবুজ মাইনষে খায়? ভ্যাপসা গন্ধ করে”।


আরেকটি জিনিষ আমার পছন্দ- “তামিয়া মোশাক্কেল”। দূর্ভাগ্যক্রমে আদিল ভাই আর মিলনের এটা পছন্দ না। তবে আদিল ভাইয়ের কাছে নাকি এখন ভালো লাগছে। মিলনতো বলে, “এটা কোনো স্মার্ট খাবার না, শরীর না বাঁচিয়ে এটা খাওয়া যায় না”।তামিয়া মোশাক্কেল খেতে গেলে মুখে হয়তো সস লেগে যাবে, জামা’র উপর ভাঙ্গা অংশ পড়বে- মানে ঝামেলা হবেই। তামিয়া মোশাক্কেল পাওয়া যায় ২ রিয়ালে। অর্ধেক খবুজের ভেতর ডিম ফালি, শষা, টমেটো, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পিয়াজু, সস ও মেয়োনেজ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটা মূলত একধরণের মিক্সড স্যান্ডউইচ।


প্রথম যখন উমরার জন্য গেলাম, ডিনারের জন্য গাড়ী থামালো মরুভূমিতে, একটা রেস্টুরেন্ট, মসজিদ আর অল্প কিছু দোকানপাট। আশে পাশে লোকালয় নেই। অথচ রেস্টুরেন্টে জমজমাট অবস্থা। অবাক ব্যপার সবাই রেস্টুরেন্টের ভেতরে নয়, বাহিরে বসে আছে। ভেতরে চেয়ার, টেবিল থাকলেও তা ফাঁকা। বাহিরে ছোট ছোট ৩ বর্গফিটের গদি মোড়ানো জায়গা, হেলান দেবার জন্য কোল বালিশ, হুক্কা, আলাদা টেলিভিশন। পরিচিতদের নিয়ে সৌদিরা এমন গদি মোড়ানো জায়গায় আড্ডা দেয়, খায় দায়, হুক্কা টানে। এমন ১০/১২ টি স্পেস দেখলাম।


আমারা খাবারের অর্ডার দিতে গেলাম। সবাই আরবি বলছে, কিছুই বুঝাতে পারলাম না। খুঁজে একজন বাংলাদেশিকে পেলাম। এই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। যা জানলাম তাতে হতাশ হলাম, বাংলাদেশি খাবারের কাছাকাছি কিছু নেই। উনি আল-ফাহাম খেতে বললেন।


বড় থালায় বিশেষ ধরনের রান্না করা ভাতের মাঝখানে ঝলসানো মুরগী। বুঝতে পারলাম না কিভাবে খাব। শুকনো আর খটখটে। একটু মজাও লাগলোনা। খেতে পারলাম না। বাহিরে এসে দেখি সৌদিরা ছোট ছোট স্পেসগুলোতে বিশাল বড় থালার চারপাশ ঘিরে মজা করে ৫/৬ টি মুরগী সহ আল-ফাহাম খাচ্ছে। আমার মনে হলো সৌদিরা খাবারের বেশ অপচয় করে, অল্প কিছু খেয়ে ফেলে দেয়। আর তারা নোংরা, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, হয়তো গাড়ী দিয়ে যাচ্ছে- পেপসির বোতলটা রাস্তার মাঝখানেই ফেলবে। বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নকর্মীরা আছে বলেই রক্ষা।


... তো উমরা হতে এসে আল-ফাহাম না খেতে পারার ঘটনাটা সবাইকে বলছিলাম... আদিল ভাই লাফ দিয়ে উঠলেন –“আরে বলো কি ঐটাইতো মজার খাবার...” ... চমকিত হলাম, আমার যেটা অপছন্দ সেটাই নাকি আদিল ভাইয়ের আর ভাবী’র সেরা। প্রসঙ্গতঃ আদিল ভাই প্রতি শুক্রবার দুপুর এবং রাতের খাবার সারেন আল-ফাহাম দিয়ে।


ঘটনাচক্রে আমার এক কাজিন একদিন তার বাসায় আমাকে দাওয়াত করলো, গিয়ে দেখি আল-ফাহাম রান্না হয়েছে। ভাগ্যবুঝি একেই বলে !!! তবে রান্নাটা বাংলাদেশি টাইপ হয়েছিল এবং ভালো লেগেছিল। সবাই মিলে সৌদি কায়দায় আল-ফাহাম খেলাম। সবাই একে অপরকে বেশী বেশী ঠেলে দিচ্ছিল।একসাথে খাওয়ার মজা বুঝি এটাই। (চলবে)



কাজিনের রান্না করা আল-ফাহাম

No comments:

Post a Comment